রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা সাহিত্যে নারীর আত্মসম্মান, স্বাধীনতা ও আত্মপরিচয় নিয়ে যেসব গল্প রচনা করেছেন, তার মধ্যে অপরিচিতা গল্পের মূল কথা পাঠককে ভাবিয়ে তোলে এবং সমাজের প্রচলিত ধ্যান-ধারণাকে প্রশ্নের মুখে ফেলে। গল্পটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯১৬ সালে এবং এর কেন্দ্রীয় চরিত্র অঞ্জলি এক ব্যতিক্রমী নারীর প্রতিচ্ছবি, যিনি নিজের আত্মসম্মানবোধের প্রশ্নে আপোস করেন না।
গল্পটি শুধু এক ব্যক্তিগত ঘটনার চিত্রায়ণ নয়, বরং সমকালীন সমাজে নারীর অবস্থান এবং তার স্বাধীন চিন্তার গুরুত্বকে তুলে ধরেছে। “অপরিচিতা” গল্পে রবীন্দ্রনাথ এক পুরুষ চরিত্রের জবানিতে নারীর আত্মসম্মান ও সমাজের চোখে তার অবস্থানকে ব্যাখ্যা করেছেন, যা আজও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক।
কাহিনির সারাংশ
পরিচয়হীন এক নারীর প্রভাব
গল্পের মূল চরিত্র ‘আমি’ বা প্রতুল একজন উচ্চশিক্ষিত যুবক, যিনি মা-বাবার ইচ্ছায় অঞ্জলি নামের এক তরুণীর সঙ্গে বিয়ের কথা চূড়ান্ত করেন। বিয়ের দিনও ঠিক হয়, কিন্তু হঠাৎ করেই প্রতুল বিয়েতে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন, কারণ অঞ্জলি ও তার পরিবার তার কাছে যথেষ্ট আধুনিক বা উচ্চশিক্ষিত মনে হয় না। এই সিদ্ধান্তে তিনি গর্ববোধ করেন এবং মনে করেন, তিনি নিজের উচ্চমার্গীয় চিন্তাধারাকে অক্ষুণ্ণ রেখেছেন।
পুনর্মিলন এবং চমকপ্রদ উপলব্ধি
এরপর একদিন কলেজে এক ভাষণ প্রতিযোগিতায় প্রতুল এক অজ্ঞাতনামা মহিলার বক্তৃতা শুনে বিস্মিত হন। তিনি জানতে পারেন, সেই বক্তৃতা দানকারী নারী আসলে সেই অঞ্জলি, যার সঙ্গে তার বিয়ে হওয়ার কথা ছিল। তখনই প্রতুল উপলব্ধি করেন যে, তার চিন্তার গভীরতা অঞ্জলির ধারেকাছে আসেও না। তার অহংকার, ভুল ধারণা এবং পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা তার জীবনের একটি মূল্যবান সম্পর্ক ধ্বংস করেছে।
মূল বার্তা
আত্মসম্মান ও নারীর স্বাধীনতা
গল্পের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো নারীর আত্মসম্মান। অঞ্জলি কোনও ব্যাখ্যা বা অভিযোগ না করেই প্রতুলের অপমানজনক ব্যবহারের পর নিজেকে আরও উন্নত ও প্রতিষ্ঠিত করেন। এতে বোঝা যায়, একজন নারীকে ছোট করে দেখার পরিণাম কতটা বড় হতে পারে এবং আত্মসম্মান রক্ষাই যে নারীর প্রকৃত শক্তি।
পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির সমালোচনা
প্রতুল একজন আধুনিক শিক্ষিত মানুষ হলেও তার মনোভাব ছিল পুরুষতান্ত্রিক। সে নারীর মেধা, ব্যক্তিত্ব বা আত্মসম্মানকে গুরুত্ব দেয়নি; বরং বাহ্যিক অবস্থা ও পারিবারিক পটভূমির ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। এই দৃষ্টিভঙ্গি গল্পে ব্যঙ্গ ও সমালোচনার মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে।
সমাজের চোখে নারীর পরিচয়
গল্পে অঞ্জলি প্রথমে পরিচিত ছিলেন ‘বিয়ের পাত্রী’ হিসেবে। কিন্তু তার নিজের চেষ্টায় ও শিক্ষার মাধ্যমে তিনি এক পরিচিত, সম্মানিত বক্তা হয়ে ওঠেন। এটা সমাজে নারীর অবস্থান পরিবর্তনের একটি প্রতীক হিসেবেই উঠে এসেছে।
চরিত্র বিশ্লেষণ
অঞ্জলি
অঞ্জলি এই গল্পের কেন্দ্রবিন্দু। তার আত্মবিশ্বাস, আত্মসম্মানবোধ এবং প্রতিহিংসাহীন আত্মোন্নয়নের গল্পটি আমাদের অনুপ্রাণিত করে। তিনি কোনো কথা না বলেই সমাজকে দেখিয়ে দেন—নারী দুর্বল নয়, বরং নিজের যোগ্যতায় প্রতিষ্ঠিত হতে সক্ষম।
প্রতুল
প্রতুল একটি সাধারণ ছেলেকে প্রতিনিধিত্ব করে, যে উচ্চশিক্ষিত হয়েও সামাজিক ও মানসিকভাবে পিছিয়ে থাকে। তার অহংবোধ তাকে একটি মূল্যবান সম্পর্ক হারাতে বাধ্য করে এবং পরে সেই সিদ্ধান্তের জন্য সে অনুতপ্ত হয়।
উপসংহার
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “অপরিচিতা” গল্পটি নারীর আত্মসম্মান, সমাজে তার অবস্থান এবং পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার বিরুদ্ধে একটি প্রতীকী প্রতিবাদ। অপরিচিতা গল্পের মূল কথা হলো—নারীকে কখনো তার বাহ্যিক অবস্থা দেখে বিচার করা উচিত নয়; বরং তার চিন্তা, বুদ্ধিমত্তা এবং চরিত্রই তার প্রকৃত পরিচয়। এই গল্প আজকের দিনে দাঁড়িয়েও পাঠককে নারীর মর্যাদা নিয়ে ভাবতে বাধ্য করে।